২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল। সময়টা ছিল নির্বাচনী উত্তাপময়। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের উপর দমন-পীড়ন চলছিল সর্বোচ্চ মাত্রায়। ঠিক সেই সময়েই, রাজশাহীতে ঘটে যায় এক ভয়াবহ ঘটনা, যা আজও হাজারো মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়।
নওদাপাড়া ইসলামী হাসপাতালের নিরাপত্তাকর্মী এবং রাজশাহী মহানগর জামায়াতের একজন সক্রিয় কর্মী শহিদুল ইসলামকে সেদিন গভীর রাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
তৎকালীন রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. শামসুদ্দিন ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এডিসি আতিকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই ‘ক্রসফায়ার নাটক’ সাজানো হয়। শহিদুল ইসলামকে রাতে নিজ কর্মস্থান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে একটি নির্জন জায়গায় খুব কাছ থেকে তাঁর বুকে তিনটি গুলি করা হয় বলে জানান একজন প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তা, যিনি নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
শহিদুল ইসলামকে আটক করে তার বাড়ির পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর স্ত্রী এবং মাত্র তিন বছরের কন্যা সাদিয়া কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্ত্রী বারবার কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন—“আমার স্বামীকে একবার দেখা করতে দাও।” ছোট্ট মেয়েটিও বাবার কোলে ওঠার জন্য ছুটে গিয়েছিল।
কিন্তু ডিবি পুলিশের উপস্থিত সদস্যদের চোখে-মুখে ছিল না একটুও করুণা। তীক্ষ্ণ ঠান্ডা সিদ্ধান্তে তাঁরা শহিদুলকে নিয়ে চলে যান, আর সেই রাতেই প্রাণঘাতী গুলিতে মৃত্যু ঘটে এক নিরীহ, নিরপরাধ, রাজনৈতিক কর্মীর।
পরদিন ১৪ এপ্রিল সকালেই রাজশাহী শহীদ জিয়া শিশু পার্কের গেটের সামনে শহিদুল ইসলামের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে স্থানীয় জনসাধারণ, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাধারণ মানুষ ভিড় করেন। জানাজায় কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকে। পরে তাঁকে রাজশাহী নগরীর ভাঁড়ারিপাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়। দাফনের সময় স্তব্ধ পরিবেশে শুধুই শোনা যাচ্ছিল পরিবার ও প্রতিবেশীদের হৃদয়বিদারক আহাজারি।
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের নেতৃবৃন্দরা বলেন,“শহিদুল ছিলেন একজন দায়িত্বশীল, সৎ এবং নির্ভীক কর্মী। তিনি সবসময় জনমানুষের পাশে থেকেছেন। তাঁর মৃত্যু ছিল একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অমানবিক।”
তারা বলেন,“তাকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র বিরোধী মতকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাঁর আদর্শ ভুলিনি। শহিদুল ইসলামের রক্ত বৃথা যাবে না, ইনশাআল্লাহ।”
স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলেন,“ক্রসফায়ারের নামে গত ১৬বছরে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের অনেকেই সম্পূর্ণ নিরপরাধ ছিলেন। শহিদুল ইসলামের ঘটনা ছিল হৃদয়বিদারক ও আইনবিরোধী।
তারা বলেন,শহিদুল ইসলামের পরিবার আজও বিচার পায়নি। স্ত্রী এখন সন্তানদের নিয়ে কষ্টে জীবন কাটান। কন্যা সাদিয়া এখন বড় হচ্ছে—জানেনা বাবার মৃত্যু কতটা নির্মম ছিল। পরিবার আজও বারবার প্রশ্ন করে—একজন সাধারণ চাকরিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীর কী অপরাধ ছিল?
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, এই ঘটনার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত হোক। দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
যেন শহিদুল ইসলাম-এর মতো আর কোনো মা’র বুক খালি না হয়, আর কোনো সন্তান এত অল্প বয়সে বাবাহীন না হয়।
আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন শহিদুল ইসলামকে শহীদের মর্যাদা দান করে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে আসীন করেন।
এই হত্যাকাণ্ড আজ শুধু রাজশাহীর নয়, পুরো বাংলাদেশের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এই লড়াই অব্যাহত থাকুক।