পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী চুড়ান্ত করার জন্য আগামী ১৫ এপ্রিল শনিবার গণভবনে দলের স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করবে আওয়ামী লীগ।
দলটির নেতারা বলছেন-সক্ষমতা, জনপ্রিয়তা, দলের সঙ্গে যোগাযোগ এবং বিভিন্ন জরিপ দেখেই তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন। তাদের মতে, বিএনপি সরাসরি ভোটে না এলেও ‘ঘোমটা পরে’ নির্বাচনের মাঠে থাকবে। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কিন্তু পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াচ্ছে আওয়ামী লীগই। বিশেষ করে গাজীপুর, বরিশাল ও সিলেট-এই তিন সিটিতে দলীয় প্রার্থীর চাপ রয়েছে।
গাজীপুরে সর্বোচ্চ ১৭ জন দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী মাঠে আছেন। সিলেটে আছেন ১০ জন। আর বরিশাল সিটি নির্বাচনে সাতজন আওয়ামী লীগের ফরম কিনেছেন।
এছাড়া রাজশাহীতে তিনজন, খুলনায় চারজন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। বিএনপি না আসার ঘোষণার মধ্যে সব মিলিয়ে এই পাঁচ সিটিতে ৪১ জন নৌকার জন্য মাঠে রয়েছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত দুই বা তিন সিটিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী থাকার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলও ভাবাচ্ছে দলটিকে। ফলে ঘরের প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়েই চিন্তায় আওয়ামী লীগ।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ২৫ মে গাজীপুর, ১২ জুন খুলনা ও বরিশাল এবং ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে। পাঁচ সিটির নির্বাচনে ভোটের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় পার্টি।
এছাড়া ইসলামী আন্দোলন ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মাঠের বিরোধী দল বিএনপি এই স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না। নির্বাচনের কোনো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না বাম জোটেও।
১৪ দলীয় জোটের শরিক কোনো দল থেকেও এখনো পর্যন্ত সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন বিএনপি দলগতভাবে অংশ না নিলেও মাঠে তাদের প্রার্থী ঠিকই থাকবে। অর্থাৎ ‘স্বতন্ত্র’ মোড়কে প্রার্থী থাকবে বিএনপিরও।
গাজীপুর: গাজীপুরের বহুল আলোচিত সিটি করপোরেশন। পাঁচ সিটির মধ্যে ঢাকার কাছের এই সিটিতে মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নেতা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লা খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, মহানগর আওয়ামী যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান রাসেল, ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণসহ ১৭ জন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছেন। দলীয় প্রতীক পেতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ ও লবিং করেছেন প্রার্থীরা।
গাজীপুর থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী অন্য প্রার্থীরা হলেন- মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মেজবাহ উদ্দিন সরকার রুবেল, মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী ইলিয়াস আহমেদ, সাবেক সংসদ সদস্য মো. আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপ-কমিটি। সদস্য আবদুল্লাহ আল মামুন, মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য আব্দুল আলিম মোল্লা, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য উপ-কমিটির সাবেক সদস্য আশরাফুজ্জামান সেলিম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টা রিয়াজ মাহমুদ আয়নাল, সাবেক সহ-সম্পাদক আজহারুল ইসলাম, সাবেক শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক মো. এসএম আশরাফুল আলম, গাজীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের, শহর আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য হারুন-অর-রশিদ ও যুবলীগের সদস্য রুহুল আমিন মণ্ডল।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুর আওয়ামী লীগে রয়েছে একাধিক অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং। সিটি নির্বাচনে একক প্রার্থীর জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে হেভিওয়েট প্রার্থীদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত কোনো আপস না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে দলীয় মনোনয়ন না পেলে এই সিটিতে আওয়ামী লীগের এক বা একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকতে পারেন।
সিলেট: গাজীপুরের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০ জন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। তারা হলেন- মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক আরমান আহমেদ শিপলু, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ, আরেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এটিএম হাসান জেবুল হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ৭ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য মাহি উদ্দিন আহমেদ, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবদুল খালিক, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহউদ্দিন সিরাজ, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সালেহ আহমদ সেলিম।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত নির্বাচনে এ সিটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন বদরুদ্দিন আহমদ কামরান। তিনি বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে হেরে যান। জানা গেছে, বিএনপি না এলেও এবারও নির্বাচনের মাঠে থাকবেন আরিফুল হক।
এদিকে কামরানের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা মূলত উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে এবং প্রত্যাশীরা বেড়েছে। এবারের নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও মেসবাহ উদ্দিন সিরাজের নাম বেশি আলোচিত হচ্ছে। আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকেও দলীয় মনোনয়নের ‘সবুজ সংকেত’ দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এবারের নির্বাচনে যে দলই মনোনয়ন পাবে তাদের এক বা একাধিক নেতা বিদ্রোহ করে মাঠে নামবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।
রাজশাহী: রাজশাহী সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে দল থেকে কে নির্বাচিত হবেন তা নিয়ে রোববার দলীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। দলীয় সূত্র জানায়, বর্তমান মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনকে মেয়র পদে পুনরায় নির্বাচন করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, রোববার দলীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি আমাকে সিটি নির্বাচনে ভোট দিতে বলেছেন।
পাঁচ সিটির মধ্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন অন্তত তিনজন। লিটনের পাশাপাশি আরও দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী হলেন- রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মাহফুজুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক ডি.বি. সরকার। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দলীয় মনোনয়ন নিয়ে লিটন এগিয়ে থাকলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এই সিটিতে একক প্রার্থী পেতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় এই শঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে। বিশেষ করে গত দিনে ডব্লিউ সরকারের মনোনয়ন কেনাকে কেন্দ্র করে এই আলোচনা জোরদার হয়েছে।
খুলনা: খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তার নাম সুপারিশ করা হয়। তালুকদার আব্দুল খালেকের পক্ষে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনে জমা দেন। তবে তালুকদার আবদুল খালেক ছাড়াও আরও তিন নেতা দলীয় প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তারা হলেন- মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য রুনু রেমা, মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, খুলনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম।
জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে বিএনপি না এলেও নির্বাচনে অংশ নিতে দলটির কাছে মনোনয়ন চাইছেন অন্য রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েকজন। আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও সামাজিক সংগঠন আগুয়ান-৭১ এর মেয়র প্রার্থীরাও মাঠে কাজ শুরু করেছেন।
বরিশাল : সবচেয়ে কম প্রার্থী বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাতজন। তবে মূল আলোচনায় বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও তার চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। দুজনই দলের মনোনয়ন চেয়ে ফরম সংগ্রহ করায় আলোচনা জমে উঠেছে।
দলীয় সূত্র বলছে, দলীয় মনোনয়নের তালিকায় বর্তমান মেয়র হিসাবে সাদিক আবদুল্লাহর সম্ভাবনাই বেশি। বরিশালে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা হলেন-মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসিম উদ্দিন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান, বিএম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মঈন তুষার, মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দিন আহমেদ।
শেয়ারনিউজ, ১৩ এপ্রিল ২০২৩