রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের খাদ্য ও রক্ষীদের রেশন নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নির্ধারিত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বন্দিরা। তাদের বরাদ্দের ৩ ভাগের ১ ভাগ সরবরাহ করা হয়। বাকি ২ ভাগ গোপনে কারাগারের বাইরে বিক্রি করা হয়। শুধু তাই নয়, কারারক্ষীদের রেশনের পরিবর্তে যে নগদ অর্থ দেয়া হয় সেখানেও পদে পদে অনিয়ম। চাল, ডাল, চিনি, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের প্রকৃত দামের অর্ধেক টাকা পান রক্ষীরা। এসব ঘটনার নেপথ্যে রাজশাহী জেল সুপার আবদুল জলিলের নেতৃত্বাধীন,জেলার মোঃ নিজাম উদ্দিন,ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ আবু সাদ্দাত ও কারারক্ষী আলমগীরসহ একাধিক কারারক্ষীর একটি শক্তিশালি সিন্ডিকেট প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। বিদ্যমান এমন পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। সংবাদ২৪ঘন্টার নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আজ ৪মার্চ বেলা ১২টার সময় রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের পেছন সাইড নদীর ধারে ডি আইজি বাস ভবনের সামনে দিয়ে একটি ভ্যানে করে ৯বস্তা করে মোট ৯০বস্তা গম কারা অভ্যান্তরের বাইরে একটি নিল রংএর পিকআপ ট্রাকে লোড করা হচ্ছে। এ সময় সংবাদ২৪ঘন্টার নিজস্ব অনুসন্ধান দল কারা অভ্যন্তর থেকে একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তার বাসবনের সামনে দিয়ে এ ভাবে ট্রাক লোড করায় কৌতুহল জন্মায় সংবাদ ২৪ঘন্টা অনুসন্ধান দলের। তারা কয়েকটি ভাগে ভিবক্ত হয়ে আড়ি পেতে থাকে কখন ও কোথায় এ গমগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। ঠিক তিনটার সময় গমবোঝায় ট্রাকটি কারাগারের পেছনদিয়ে সার্কিট হাউস হয়ে সিটিহাট দিয়ে সোজা নওগাঁ রোডে যেতে থোকে । এক সময় মোহনপুর থানা কেশরহাটে গিয়ে ট্রাকটি তার গতি থামিয়ে দিলে সংবাদ ২৪ঘন্টা টিম রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন, বিপিএম(বার) কে জানালে তিনি মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জের মাধ্যমে গম বোঝায় পিকআপ ট্রাক ড্রাইভার হাসেন আলী (৪৫)কেসহ আটক করে। ট্রাক চালক বাগমারা হাসনিপুর গ্রামের মৃত ফরজ মৃধার ছেলে। ট্রাকটি আটক করতেই বেরিয়ে আসে জেল সুপারের নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেটটির আসল রহস্য।
ট্রাকড্রাইভার জানান, আজ বেলা ১১টার সময় রাজশাহী সাহেববাজারে মুদি দোকানদার হুমায়ুনের কথামতো রাজশাহী কারাগারের পেছন সাইডে আমার পিকআপ ট্রাকটি নিয়ে যায়। এ সময় কারারক্ষী আলমগীর আমাকে ভ্যানের মাধ্যমে মালামালগুলো বুঝিয়ে দেয়। আমি তার কথামতো মালামাল গুলো কেশরহাট মোহনগঞ্জ এর আবুল হোসেন এর কাছে বুঝিয়ে দিতে নিয়ে এসেছি। সে প্রতিমাসে দুই তিনবার এমন কারাগার থেকে চাল,গম,ডাল,তেল,চিনি বের করে রাজশাহী সাহেববাজারে মুদি দোকানদার হুমায়ুনের গোডাউন ও তার কথামত বিভিন্ন স্থানে দিয়ে আসি বলে জানান পিকআপ ট্রাকের ড্রাইভার।
এ বিষয়ে রাজশাহী সাহেববাজারে মুদি দোকানদার হুমায়ুনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন,আমি এক মুদি দোকানদার। আমি প্রতিমাসে জেলার মোঃ নিজাম উদ্দিন,ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ আবু সাদ্দাত ও কারারক্ষী আলমগীরের মাধ্যমে চাল,গম,ডাল,তেল,চিনি কারাগার থেকে বের করি। আমি বর্তমানে কারাগারে জেলার ও ডেপুটি জেলার এর সাথে আছি । তাদের একটি প্রত্যায়ন নিয়ে মোহনপুর থানায় যাবো। এসে আপনার সাথে দেখা করছি বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে মোহনপুর থানার অফিসার ইনচার্জ বলেন, গম ভর্তি পিকআপ গাড়ি আটক করা হয়েছে । বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করে দেখছি । বিস্তারিত পরে জানাচ্ছি।
কারাগারের পেছন দিয়ে গম বেরকরা বিষয়ে কারাগারের জেলার মোঃ নিজাম উদ্দিন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকে একট্রাক মালামাল বের করার কথা স্বীকার করেন। সেইসাথে এতোগুলো মাল একসাথে বের করা উচিত হয়নি বলেও স্বীকার করেন। তিনি বলেন যে গমগুলো বেরিয়েছে সেগুলো কারারক্ষীদের রেশনের। আর আমার কারাগারে গোদামে বন্দীদের কোন কিছুর কমতি নেই। সাহেববাজারে মুদি দোকানদার হুমায়ুন রাত্রি সাড়ে আটটার সময় মোহনপুরে আটক মালামালের প্রত্যায়ন নিয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে কোন সংবাদ করতে বারন করেন তিনি।
এ বিষয়ে জেল সুপার আবদুল জলিলের সাথে কথা বলার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। তবে তার বিষয়ে অনুসন্ধানে অনেক চাঞ্চল্য তথ্য বেরিয়ে আসে। যা নিম্নে বর্ননা রয়েছে।
অনুসন্ধানে কারারক্ষীদের রেশন থেকে কিভাবে জেল সুপারের নেতৃত্বাধীন এ জেলার সিন্ডিকেট টাকা আয় করে এর একটি বিশদ বর্ণনা পাওয়া গেছে। একজন কারারক্ষী এ প্রসঙ্গে সংবাদ ২৪ঘন্টাকে বলেন, অবিবাহিত কারারক্ষী প্রতি মাসে ১১ কেজি চাল, ১২ কেজি গম, সাড়ে ৩ কেজি ডাল, আড়াই কেজি তেল ও পৌনে ২ কেজি চিনি পাওয়ার কথা। কিন্তু এ রেশন তারা পান না। কারারক্ষীদের বলা হয়, চাল-ডাল ভালো না। কিনে খান। নামকাওয়াস্তে অবিবাহিত কারারক্ষীদের রেশন বিক্রির নগদ অর্থ ধরিয়ে দেয়া হয়। ওই সিন্ডিকেটের পক্ষ থেকে কারারক্ষীদের বলা হয়, রেশনের প্রতি কেজি চালের বাজার মূল্য ৩৬ টাকা, গম ২৬ টাকা, ডাল ১শ’ টাকা, তেল ১শ’ টাকা এবং চিনি ১শ’ টাকা।কিন্তু বাস্তবে যে টাকা দেয়া হয় তা হচ্ছে- প্রতি কেজি চাল ১৮ টাকা, গম ১৬ টাকা, ডাল ৭০ টাকা এবং চিনি ৪০ টাকা।
একাধিক কারারক্ষী সংবাদ ২৪ঘন্টাকে জানান, কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি বড় পুকুর আছে। ওই পুকুরের মাছ বন্দিদের পেটে যায় না। সেগুলো বিক্রি করে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা নেন সিন্ডিকেট সদস্যরা।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে চাকুরী করা কালীন সময়ে সেখানকার সীমানার বাইরে জেল সুপার আবদুল জলিলের ছোট ভাই আবদুল কাদের বাদশার নামে একটি জমি পাওয়া যায়। ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়ি থেকে সিলেটের বাঁধাঘাটে ধুপনীখোলা মৌজায় সাড়ে তিন শতক জমি কেনার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে এ দলিল সম্পাদন হয়। ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন উত্তর বাগবাড়ীর হাজী মো. শফিক মিয়ার কাছ থেকে এ জমি কিনে নেন তিনি। কিন্তু এ জমির পেছনে একটি লেনদেনের হিসাব রয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
অনুসন্ধানে আরো জানাযায়, আবদুল জলিল সমাজসেবা অফিসার হিসেবে প্রথম চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর ২০১০ সালে বিসিএস তথ্য ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবেও তার চাকরি হয়। সমাজসেবা অফিসার হিসেবে এক সময় তিনি গাজীপুর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় কারারক্ষীদের সঙ্গে তার একটা সংযোগ হয়। তাদের কাছ থেকে জেল সুপারদের আয়ের একটা ধারণা পান তিনি। সেই ধারণা থেকেই তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তার চাকরি ছেড়ে দিয়ে জেল সুপার পদে যোগ দেন আবদুল জলিল। জেল সুপার পদে যোগদানের পর তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের পাল্লা ভারি হতে থাকে।
সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার থাকা কালিন আব্দুল জলিলকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ নিয়ে কারা অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ, অর্থের বিনিময়ে বন্দিদের অবৈধ সুবিধা, অর্থ লেনদেন এবং অবৈধ ক্যান্টিন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ বিষয়েগত ২০২২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার খবরও মেলে অনুসন্ধানে।
রাজশাহী জেল সুপার আবদুল জলিলের নেতৃত্বাধীন,জেলার মোঃ নিজাম উদ্দিন,ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ আবু সাদ্দাত ও কারারক্ষী আলমগীরসহ একাধিক কারারক্ষীর একটি শক্তিশালি সিন্ডিকেটের ভিডিও তথ্য নিয়ে আমরা আসছি । আমাদের সাথে থাকুন।