বাংলাদেশে রাস্তা-ঘাটে বসবাসকারী শিশুদের মোট সংখ্যার হিসেব না থাকলেও ইউনিসেফের একটি জরিপ বলছে, এই সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক হতে পারে। এমনকি এসব শিশুদের প্রায় ৭ শতাংশ শিশু রাতে সম্পূর্ণ একা ঘুমায়। এছাড়াও ১৭ শতাংশ শিশু কয়েকজন একসঙ্গে মিলে ঘুমানোর মাধ্যমে সুরক্ষা ও স্বস্তি খোঁজে। তবে, এসব শিশুদের সহিংসতার প্রতি তিনটি ঘটনার একটিই (৩০ দশমিক ৪ শতাংশ) রাতে তাদের ঘুমের সময় ঘটে থাকে।
ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন-২০২২’ শীর্ষক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সোমবার (১০ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁও পরিসংখ্যান ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ইউনিসেফ বলছে, ঢাকা এবং দেশের আটটি বিভাগের হটস্পটে (যেসব স্থানে পথশিশুর আনাগোনা বেশি) ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ হাজার ২০০ শিশুর কাছে সরাসরি গিয়ে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদন করা হয়েছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এই শিশুদের বেশিরভাগই ছেলে (৮২ শতাংশ) এবং তাদের বেশিরভাগ দারিদ্র্যের কারণে বা কাজের সন্ধানে রাস্তায় আসে। প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ৬ শতাংশ শিশু এতিম অথবা তাদের বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা তা তাদের জানা নেই।
রাস্তায় ঘুমানো
রাস্তায় বসবাসকারী এসব শিশুদের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন (৩০ শতাংশের বেশি) জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সুযোগ-সুবিধা, যেমন ঘুমানোর জন্য বিছানা এবং নিরাপত্তা ও স্বস্তির জন্য দরজা বন্ধ করে রাখা যায় এমন ঘর থেক বঞ্চিত। তারা খোলা জায়গায় থাকে ও ঘুমায়। প্রায় অর্ধেক শিশু মাটিতে ঘুমায় শুধু একটি পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরো বা একটি পাতলা কম্বল নিয়ে।
জরিপে বলা হয়েছে, রাস্তায় বসবাসকারী শিশুরা সবচেয়ে বেশি লজ্জাজনক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয় পথচারীদের দ্বারা। জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের প্রতি ১০ জনের মধ্যে আটজনই পথচারীদের দ্বারা নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছে।
জরিপে ১২ বছর বয়সী হাসিব নামক এক পথশিশুর বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সরকারি সমাজকর্মীদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পাওয়ার আগে হাসিব ও তার মা রাস্তায় থাকতো। হাসিবের ভাষ্য মতে, ‘আমাদের প্রতি লোকজনের বাজে আচরণে আমি অনেক কষ্ট পেতাম– আমরা ঘুমানোর চেষ্টা করলে তারা আমাদের দিকে পানি ছুড়ে মারত। তারা আমাদের অপমানজনক নামে ডাকতো’।
টিকে থাকার জন্য কাজ করা
জীবিকা নির্বাহের জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বর্জ্য সংগ্রহ, ভিক্ষাবৃত্তি বা চায়ের দোকানে, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করতে বাধ্য হওয়া এই শিশুরা প্রতিদিন আঘাত ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।
জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের এক তৃতীয়াংশ শিশু কাজ করার সময় আহত হওয়ার কথা জানায়। আর অর্ধেক শিশু জানায় সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা। কর্মরত শিশুদের প্রায় অর্ধেকই নয় বছর বয়স থেকে কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব শিশুর বেশির ভাগই সপ্তাহে এক হাজার টাকা বা ১০ ডলারের কম অর্থের জন্য প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করছে।
নিরক্ষরতা, অসুস্থতা ও বিচ্ছিন্নতা
রাস্তায় থাকা শিশুদের প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন (৭১ দশমিক ৮ শতাংশ) পড়তে বা লিখতে পারে না, যা জীবনভর তাদের জন্য প্রতিবন্ধক হিসেবে রয়ে যায়। এটা তাদেরকে নির্মম ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়।
জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের অর্ধেকের বেশি জানায়, জরিপের আগে তিন মাসের মধ্যে তারা অসুস্থ হয়েছিল। ওই সময় তারা জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা ও পানিবাহিত রোগে ভোগে। জরিপ থেকে আরও জানা যায়, রাস্তায় থাকা শিশুদের সেবা প্রদান করে এমন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা যে সহায়তা পেতে পারে সে সম্পর্কে বেশিরভাগ শিশুই (৭৯ শতাংশ) অবগত ছিল না।
সমাজকর্মীদের পেছনে বিনিয়োগ করা
সমাজকর্মী, যারা এই শিশুদের সহায়তা করতে পারে, তাদের পেছনে আরও বিনিয়োগের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে ইউনিসেফ। একই সাথে প্রতিটি গ্রাম ও কমিউনিটিতে যেন একজন সমাজকর্মী থাকেন, যিনি সবকিছুর আগে শিশুদের ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রাখতে এবং শিশুর পথে আসার মতো পরিস্থিতি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেবেন- এই লক্ষ্যে ইউনিসেফ দেশের সমাজসেবা কর্মী বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বলেন, প্রতিবেদনে উঠে আসা পথশিশুদের এই বাস্তব চিত্র দেশের পথশিশুদের পরিস্থিতি মোকাবিলায় নীতিমালা প্রণয়ন ও কর্মসূচি গ্রহণে সহায়ক হবে বলে আশা করা যায়।
জরিপ প্রসঙ্গে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়গুলো বেদনাদায়ক। এই বিষয়গুলো কেবল আমাদের কাজ করার জায়গাগুলো দেখিয়ে দেয় না, রাস্তায় বসবাস ও কাজ করা শিশুদের জন্য আমাদের সহানুভূতি এবং সহায়তার প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরে।